ঈশ্বরদী উপজেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর কেটে গেলেও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে নেই কোন উদ্যোগ। নেই শহীদদের তালিকা, পরিবারগুলো পায়নি শহীদ পরিবারের মর্যাদা। মহান মুক্তিযুদ্ধে ঈশ্বরদীতে ঘটেছে নির্মম নৃশংস ঘটনা। প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেসময়ে প্রায় ২০ হাজার অবাঙালি (বিহারী) এখানে বাস করতেন। এদের অত্যাচারে বাঙালিরা শহরে যাতায়াত করতে পারতেন না। শহরে বাঙালি পেলেই ধরে নিয়ে হত্যা করা হতো।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় বিহারীরা ঈশ্বরদী দখলের দু’দিন পর ১৩ এপ্রিল সকালে কর্মকার পাড়ায় চন্দ্রকান্ত পালের পরিবারে ওপর হামলা করে। চন্দ্রকান্ত পাল, তাঁর ২ পুত্র, ২ পুত্রবধু, ৬ নাতি-নাতনী ও একজন দোকান কর্মচারীসহ ১২ জনকে কুপিয়ে হত্যা করে। সকলকে বাড়ির কুয়ার মধ্যে ফেলে গণকবর দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্য মাধব পাল শহীদ পরিবারের মর্যাদার দাবী জানিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, চিহ্নিত বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে প্রায় ৩০টি। বধ্যভূমির বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গণকবর। গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো এখন অযত্ম, অবহেলা আর দৃষ্টিসীমার বাইরে। এসব স্থান ঘাস, ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ, পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে। বসতবাড়িও নির্মাণ হয়েছে। স্বজন হারানো শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি, বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিফলক নির্মাণের। পাশাপাশি রাষ্ট্রিয়ভাবে শহীদ পরিবারের মর্যাদা। আগামী প্রজন্ম যেন মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমী মানুষের আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারবে।
একাত্তরের ১১ এপ্রিল পাকসেনাদের আগমনের কথা ছড়িয়ে পড়লে কিছু মানুষ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়। তাঁরা ভেবেছিলো মুসলিম তাই মসজিদে হামলা হবে না। কিন্তু হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনে মসজিদেও হানা দেয়। ১২ থেকে ১৯ এপ্রিলের মধ্যে মসজিদে আশ্রয় নেয়া ১৯ জনকে প্রেসক্লাব সংলগ্ন কয়লা ডিপোতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আশপাশের মহল্লা থেকে বাঙালীদের ধরে এনে এখানে হত্যা করে গণকবর দেয়।
পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের ডাঃ রফিক আহমেদকে ৩ ছেলেসহ পরিবারের ৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১২ এপ্রিল পাকশীতে রেলের বাসায় নারকীয় গণহত্যা চালায় বিহারী ও হানাদার বাহিনী। পাকশীতে পানির ট্যাঙ্কির নিকট রাস্তার পাশে এদের সমাহিত করা হয় গণকবরে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকশী পেপার মিল, অফিসার্স মেস ও হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পুলিশ ফাঁড়িতে ক্যাম্প করেছিল পাক বাহিনী। ক্যাম্পে বন্দীদের হত্যা করে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। পাকশী রেলস্টেশনের বাম দিকের জঙ্গলে ফেলা হয় বহু লাশ। পরবর্তীকালে এটিকে গণকবর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অবাঙালীদের সহয়তায় লতিফ, আঁতু ও নান্নু তিন সহোদরকে পাকশী রেলকলোনীর ভেতরে হত্যা করে। পড়ে সুইপাররা কলোনীর মধ্যেই গর্ত করে মাটি চাপা দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ বাঙালিরা ঈশ্বরদী রেল জংশন দিয়ে ট্রেনযোগে যাতায়াত করতো। বিহারিরা ট্রেনে আগত যাত্রীদের ধরে নিয়ে জবাই ও গুলি করে হত্যা করতো। রেলের ফাঁকা জায়গায় অসংখ্য বাঙালিদের হত্যার পর অবাঙালি ও রাজাকারেরা মাটির নিচে চাঁপা দিয়ে রাখতো। শহরের আলহাজ্ব মিলের পেছনের কাশবনে প্রায় দুই শতাধিক নর-নারীকে হত্যা করে। আজও এ বধ্যভূমি ও গণকবর শনাক্ত করা হয়নি। ২৩ এপ্রিল পাকসেনারা বাঘইল পশ্চিমপাড়ার একটি বাড়িতে ২৩ জন নর-নারীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। গ্রামবাসী পরে লাশগুলো একটি বিশাল গর্ত করে পুঁতে ফেলে।
ফতেহমোহাম্মদপুর লোকসেড এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ছত্রছায়ায় বিহারীরা ১২ ও ১৩ এপ্রিল অসংখ্য বাঙালিকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। আজিজুল গনি, আব্দুল বারীসহ প্রায় ৩০-৩৫ জন এখানে শহীদ হন। ফতেমোহাম্মদপুর রেলওয়ে কলোনি অর্থাৎ লোকোসেড পাম্প হাউজ স্টেশনে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। গুলির পরিবর্তে এখানে ধারালো তরবারি বা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে। রেলওয়ের এ পরিত্যাক্ত পাম্প হাউজে কত বাঙালিকে যে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি।
লোকসেডের উত্তর পাশে বর্তমান পানির ট্যাংকির পেছনে খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছোট বটগাছের নিচে রয়েছে একটি গণকবর। অথচ কবর বাঁধানো এমনকি নামফলক বা স্মৃতিচিহ্ন নেই, যা দেখে মানুষ বুঝতে পারবে মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী বাঙালিরা এখানে ঘুমিয়ে আছে। নুরমহল্লার খেলার মাঠের উত্তর কোণে রয়েছে একটি গণকবর। এখানে ১০-১২ জন শহীদ ঘুমিয়ে আছেন। মাজদিয়া মাদ্রাসা পাড়ার একটি স্থানে অসংখ্য নিরীহ বাঙালীকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। এলাকাটি এখনও জামায়াত অধ্যুষিত বলে এই গণকবরগুলো চিহ্নিত করা হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা চান্না মন্ডল জানান, মুক্তিযুদ্ধে ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য বাঙালি শহীদ হন। এখনও শহীদদের কবর ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর আর ২৬ মার্চ এলে রণাঙ্গনে শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধাদের কবরগুলোতে আমরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু তাদের কবরগুলোও রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দাবি, অতিশীঘ্র মুক্তিযোদ্ধাদের কবর ও শহীদদের গণকবরগুলো চিহিৃত করে সংরণ এবং স্মৃতিফলক নির্মাণ। যাতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারে গণকবরগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগী শহীদদের।
শহীদ হওয়া মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে বীরমুক্তিযোদ্ধা তহুরুল আলম মোল্লা জানান, পাকসেনা, রাজাকার ও বিহারীরা ১৭ এপ্রিল মসজিদে আশ্রয় নেয়া তাঁর পিতা মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বহু মুসল্লিকে ধরে এনে প্রেসক্লাবের পাশে কয়লা ডিপোর কাছে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, লেখক ও বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদদের কবর চিহ্নিত ও সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে এসব বধ্যভূমি, গণকবর সংরক্ষণ ও নামফলক নির্মাণ অত্যাবশ্যকীয়।
( লেখক: অিবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক)